ফিতরার আলোচনা |সদকায়ে ফিতর কার উপর ওয়াজিব | ফিতরার পরিমান

ফিতরার আলোচনা |সদকায়ে ফিতর কার উপর ওয়াজিব

ফিতরার আলোচনা |সদকায়ে ফিতর কার উপর ওয়াজিব | ফিতরার পরিমান

ফিতরা বা ফেতরা(فطرة) আরবী শব্দ, যা ইসলামে যাকাতুল ফিতর (ফিতরের যাকাত) বা সাদাকাতুল ফিতর (ফিতরের সদকা) নামে পরিচিত। ফিতর বা ফাতুর বলতে সকালের খাদ্যদ্রব্য বোঝানো হয় যা দ্বারা রোজাদারগণ রোজা ভঙ্গ করেন।
যাকাতুল ফিতরঃ-যাকাতুল ফিতর বলা হয় ঈদুল ফিতর উপলক্ষে গরীব দুঃস্থদের মাঝে রোজাদারদের বিতরণ করা দানকে। রোজা বা উপবাস পালনের পর সন্ধ্যায় ইফতার বা সকালের খাদ্য গ্রহণ করা হয়। সেজন্য রমজান মাস শেষে এই দানকে যাকাতুল ফিতর বা সকাল‌ের আহারের যাকাত বলা হয়। [২]
নারী-পুরুষ, স্বাধীন-পরাধীন, শিশু-বৃদ্ধ, ছোট-বড় সকল মুসলিমের জন্য ফিতরা প্রদান করা ওয়াজিব। ইবনে উমর (রাঃ) থেকে জানা যায়ঃ
فرض رسول الله صلى الله عليه وسلم- زكاة الفطر صاعاً من تمر أو صاعاً من شعير، على الذكر والأنثى والصغير والكبير والحر والعبد من المسلمين، وأمر أن تؤدى قبل خروج الناس للصلاة” متفق عليه রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রত্যেক স্বাধীন-ক্রতদাস, নারী-পুরুষ, ছোট-বড় মুসলমানের যাকাতুল ফিতর ফরজ করেছেন এক ‘সা’ পরিমাণ খেজুর বা যব ফরজ করেছেন। তিনি লোকদের ঈদের নামাযে বের হওয়ার পূর্বেই তা আদায় করার আদেশ দিয়েছেন।

সদকায়ে ফিতর কার উপর ওয়াজিব

ফিতরার যাকাত প্রত্যেক সেই মুসলিমের উপর ফরয, ঈদের রাত ও দিনে যার একান্ত প্রয়োজনীয় এবং নিজের তথা তার পরিবারের আহারের চেয়ে অতিরিক্ত খাদ্য মজুদ থাকে। আর এ ফরযের ব্যাপারে সকল ব্যক্তিত্ব সমান। এতে সবাধীন ও ক্রীতদাস, পুরুষ ও নারী, ছোট ও বড়, ধনী ও গরীব, শহরবাসী ও মরুবাসী (বেদুইন) এবং রোযাদার ও অরোযাদারের মাঝে কোন পার্থক্য নেই। এক কথায় এ যাকাত সকলের তরফ থেকে আদায়যোগ্য।
.
এ সদকাহ ফরয হওয়ার জন্য যাকাতের নিসাব হওয়া শর্ত নয়। যেহেতু তা ব্যক্তির উপর ফরয, মালের উপর নয়। মালের সাথে তার কোন সম্পর্কও নেই এবং মাল বেশী হলে তার পরিমাণ বেশীও হয় না। বলা বাহুল্য, এ সদকাহ কাফ্ফারার মত; যা ধনী-গরীব সকলেই আদায় করতে বাধ্য। যেমন ‘‘প্রত্যেক সবাধীন ও ক্রীতদাস বান্দার জন্য---’হাদীসের এই শব্দও ধনী-গরীব সকলের জন্য ব্যাপক; চাহে সে নিসাবের মালিক হোক অথবা না হোক।

ঈদের দিন সকালেও যদি কেউ মৃত্যুবরণ করেন, তার জন্য ফিৎরা আদায় করা ফরয নয়। আবার ঈদের দিন সকালে কোন বাচ্চা ভূমিষ্ঠ হ’লে তার পক্ষ থেকে ফিৎরা আদায় করা ফরয।কোন ব্যক্তি ছিয়াম পালনে সক্ষম না হ’লেও তার জন্য ফিৎরা ফরয।

যার ভরণ-পোষণ করা ওয়াজেব, তার তরফ থেকেও ফিতরার যাকাত আদায় করা ওয়াজেব; যেমন স্ত্রী-সন্তান প্রভৃতি - যদি তারা নিজেদের যাকাত নিজেরা আদায় করতে সক্ষম না হয় তাহলে। অন্যথা তারা নিজেরা নিজেদের ফিতরাহ আদায় করলে সেটাই উত্তম। যেহেতু শরীয়তের আদেশে প্রত্যেক ব্যক্তিকে সরাসরি সম্বোধন করা হয়। তাছাড়া ইবনে উমার (রাঃ)-এর হাদীসে বলা হয়েছে যে, আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) ছোট-বড় এবং সবাধীন-ক্রীতদাস; যাদের ভরণ-পোষণ তোমাদেরকে করতে হয় তাদের সকলের পক্ষ থেকে ফিতরার সদকাহ আদায় করতে আদেশ করেছেন।

ফিতরার আলোচনা |সদকায়ে ফিতর কার উপর ওয়াজিব | ফিতরার পরিমান

দকাতুল ফিতরের পরিমাণ: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর যুগের এক সা’। যার ওজন চার শত আশি মিসকাল গম। ইংরেজী ওজনে যা দুই কেজি ৪০ গ্রাম গম। যেহেতু এক মিসকাল সমান চার গ্রাম ও এক চতুর্থাংশ হয়। সুতরাং ৪৮০ মিসকাল সমান ২০৪০ গ্রাম হয়। অতএব রাসূলের যুগের সা’ জানতে ইচ্ছা করলে,তাকে দুই কেজি চল্লিশ গ্রাম গম ওজন করে এমন পাত্রে রাখতে হবে, যা মুখ পর্যন্ত ভরে যাবে। অতঃপর তা পরিমাপ করতে হবে।
فرض رسول الله صلى الله عليه وسلم صدقة الفطر ، صاعا من شعير أو صاعا من تمر ، على الصغير والكبير ، والحر والمملوك
ইবনে ওমর রা. বলেন,রাসূল স. সদকাতুল ফিতর আবশ্যক করেছেন। এর পরিমাণ হলো,এক সা যব বা এক সা খেজুর। ছোট-বড়,স্বাধীন-পরাধীন সবার ওপরই এটা আবশ্যক। (বুখারী : ১৫১২)
كنا نخرج زكاة الفطر ، صاعا من طعام ، أو صاعا من شعير ، أو صاعا من تمر ، أو صاعا من أقط ، أو صاعا من زبيب
আমরা সদকাতুল ফিতর আদায় করতাম এক সা খাদ্য দ্রব্য দিয়ে। তা এক সা যব, এক সা খেজুর, এক সা পনীর বা এক সা কিসমিস দিয়ে। (বুখারী : ১৫০৬)
সদকাতুল ফিতরের হকদার :সদকাতুল ফিতর হকদার হচ্ছে: (১) দরিদ্র (২) ঋণ আদায়ে অক্ষম (৩) ঋণগ্রস্ত,তাকে প্রয়োজন পরিমাণ দেয়া যাবে।
এক সদকাতুল ফিতর অনেক ফকীরকে দেয়া যাবে এবং অনেক সদকাতুল ফিতর এক মিসকিনকেও দেয়া যাবে। যেহেতু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সদকাতুল ফিতরের পরিমাণ নির্ধারণ করেছেন,কিন্তু হকদারকে কি পরিমাণ দিতে হবে তা নির্ধারণ করেননি। সুতরাং যদি অনেক ব্যক্তি তাদের সদকাতুল ফিতর ওজন করার পর একটি পাত্রে জমা করে এবং সেখান থেকে তা পুনরায় পরিমাপ ছাড়া বণ্টন করে,তবে তা বৈধ হবে। কিন্তু ফকীরকে জানিয়ে দেয়া উচিৎ। তাকে তারা যা দিচ্ছে তার পরিমাণ তারা জানে না। ফকীরের জন্য বৈধ,কারো থেকে সদকাতুল ফিতর গ্রহণের পর নিজের পক্ষ থেকে বা পরিবারের অন্য সদস্যের পক্ষ থেকে দাতার কথায় বিশ্বাস করে পরিমাপ ছাড়াই কাউকে কিছু দেয়া।

ফিতরা কি দিবেনঃ-আবু সাঈদ খুদরী (রাযিঃ) বলেন: “আমরা-নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগে যাকাতুল ফিতর বের করতাম এক সা খাদ্য দ্রব্য কিংবা এক সা যব কিংবা এক সা খেজুর কিংবা এক সা পনীর কিংবা এক সা কিশমিশ। এই হাদীসে খেজুর ও যব ছাড়া আরও যে কয়েকটি বস্তুর নাম পাওয়া গেল তা হল: কিশমিশ, পনীর এবং খাদ্য দ্রব্য। উল্লেখ থাকে যে, নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর বিগত হওয়ার পরে মুআবীয়া (রাযিঃ)-এর খেলাফতে অনেকে গম দ্বারাও ফিতরা দিতেন।
এ থেকে এটি স্পষ্ট যে, যাকাতুল ফিতর টাকা পয়সা নয়, বরং খাদ্য হতে হবে। তাই সুন্নাহে যা বর্ণিত হয়েছে আমাদেরকে তার অনুসরণ করতে হবে।এতএব আপনার নিজের এবং আপনার পরিবারের প্রত্যেক সদস্যের পক্ষ থেকে আপনার দেশের প্রধান খাদ্য, যেমন চাউল বা গম এক সা’ পরিমাণ প্রদান করুন। 

ফিতরা সংক্রান্ত প্রাসঙ্গিক কিছু মাসায়েলঃ 
১.[মাসয়ালা]: সদকায়ে ফিতর ও জাকাত দ্বারা কারো হক আদায় করা যায় না। বেতন যেহেতু চাকুরিজীবির প্রাপ্য তাই ফিতরা দ্বারা বেতন আদায়ের দায়িত্ব থেকে উদ্ধার পাওয়ার ব্যবস্থা করা বৈধ হয় না। কোনো চাকুরিজীবি ও কর্মচারী জাকাত-ফিতরা খাওয়ার উপযোগী হলে তাকে ফিতরার টাকা দেওয়া যাবে, কিন্তু এ টাকা বেতন হিসেবে ধরা যাবে না। পক্ষান্তরে জাকাত খেতে পারে- এমন না হলে ফিতরার টাকা দেওয়া-নেওয়া কোনো অবস্থাতেই জায়েয হবে না। (আদ্দুররুল মুখতার: ২/৩৬৮) 
.[মাসয়ালা]: ঈদের নামাজের পূর্বেই ফিতরা আদায় করে দেওয়া উত্তম, তবে পরে দিলেও আদায় হয়ে যাবে। হজরত ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) ঈদগাহে যাওয়ার পূর্বে সদকাতুল ফিতর আদায় করার নির্দেশ দিয়েছেন।  (সহীহ বুখারী, অধ্যায়: যাকাত হাদীস নং ১৫০৩; মুসলিম শরিফ, হাদিস: ১৬৩৬,২২৭৫; সুনানে আবু দাউদ, হাদিস: ১৬০৯)
.[মাসয়ালা]ঃঈদের দিনের পূর্বে সদকা ফিতির দেওয়াও বৈধ। কেননা, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর যামানায় সাহাবীগণ ঈদের দিনের আগেই সদকা ফিতির আদায় করে দিতেন।যে ব্যক্তি ঈদের নামাযের আগেই সদকা-ফিতির আদায় করবে, তার ফিতরা মকবুল হিসাবে গন্য হবে। আর যে ঈদের নামাযের পরে আদায় করবে, তার ফিতরা সাধারণ সদকা গণ্য হবে।(মিনহাতুল খালেক আলা বাহররি রায়েক- ২/২৫১;জামউল ফাওয়ায়েদ- ১/১৪৫;হেদায়া : ১/১৯৩; ফাতাওয়া হিন্দিয়া : ১/১৯২ ) 
৪.[মাসয়ালা]: কোনো শিশু সন্তান ঈদের দিন সুবহে সাদেরকের আগে জন্মগ্রহণ করলে, তার পক্ষ থেকে সদকা ফিতির আদায় করা ওয়াজিব। আর সুবহে সাদেকের পরে জন্ম নিলে তার ক্ষেত্রে এ বিধান প্রযোজ্য নয়।(ফাতওয়া আলমগিরী- ১/১৯২;কিফায়তুল মুফতী- ৪/২৯৪ ; বাদায়েউস সানায়ে : ২/২০৬)
.[মাসয়ালা]: একজন মানুষের ফিতরা একজন অথবা একাধিক ফকীরকে দিতে পারবে।(হাশিয়ায়ে তাহতাবী আলা মারাকী- ৫৯৬)।
.[মাসয়ালা]: যদি পাগল ছেলের নিজস্ব সম্পদ থাকে এবং সে বাবার তত্ত্বাবধানেই থাকে, তাহলে তার পক্ষ থেকে বাবাকেই সদকায়ে ফিতর আদায় করতে হবে। এ জন্য পাগলের সম্পত্তি ব্যয় করা যাবে না। (ফাতাওয়া হিন্দিয়া: ১/১৯২)
.[মাসয়ালা]: বাবা ছেলের ওপর নির্ভরশীল হলে এবং ছেলের পরিবারে থাকলেও ছেলের ওপর বাবার সদকায়ে ফিতর আদায় করা ওয়াজিব নয়। বরং এ ক্ষেত্রে বাবার মালিকানায় নিসাব পরিমাণ প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদ থাকলে বাবার ওপরই সদকায়ে ফিতর ওয়াজিব হবে, অন্যথায় নয়।(রদ্দুল মুহতার : ২/৩৬৩)
.[মাসয়ালা]: বাবা-মা, স্ত্রী ও বালেগ সন্তানদের পক্ষ থেকে সদকা ফিতর আদায় করা ওয়াজিব নয়। তারা নিজেরা প্রয়োজনের অতিরিক্ত নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হলে তাদের ওপর সদকা ফিতর আদায় করা ওয়াজিব। কিন্তু তাদের পক্ষ থেকে যদি 
সন্তান,স্বামী বা পিতা সদকায়ে ফিতর আদায় করে দেয় তা আদায় হয়ে যাবে। এ ক্ষেত্রে তাদের অনুমতি জরুরি নয়। তবে তা আদায়ের আগে তাদেরকে বলে নেয়া ভালো।[ফাতাওয়া তাতারখানিয়া : ১/২২৮;মারাকিল ফালাহ : ৩৯৫ 
.[মাসয়ালা]: বালেগ ছেলেমেয়ে সম্পদের মালিক হোক বা না হোক কোনো অবস্থায়ই তাদের পক্ষ থেকে বাবা বা মাকে সদকা ফিতর আদায় করতে হবে না। আর প্রাপ্তবয়স্ক ছেলেমেয়ে নিজেরা নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক না হলে তাদের ওপরও সদকায়ে ফিতর ওয়াজিব নয়। অবশ্য তারা যদি নিসাব পরিমাণ সম্পত্তির মালিক হয় তাহলে তারা নিজ সম্পদ থেকে তা আদায় করবে। তবে এমন ছেলেমেয়ের পক্ষ থেকে তার অভিভাবক তাদের অনুমতি সাপেক্ষে সদকা ফিতর দিয়ে দেয়, তবে তা আদায় হয়ে যাবে।বাদায়েউস সানায়ে : ২/২০২-২০৩)
১০.[মাসয়ালা]: নাবালেগ সন্তানদের সম্পদ থাকলে বাবা তাদের সম্পদ থেকেও সদকাতুল ফিতর আদায় করতে পারবেন। মারাকিল ফালাহ : ৩৯৪; ফাতাওয়া হিন্দিয়া : ১/১৯২)
১১.[মাসয়ালা]: নিতান্ত গরিব ভাইবোনদের সদকাতুল ফিতর দেয়া জায়েজ। (ফাতাওয়া হিন্দিয়া : ১/১৯০)

                               
Previous Post Next Post