মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর উপর অত্যাচার

মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর উপর অত্যাচার

মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর উপর অত্যাচার
★★★ সমস্ত যুক্তি, কৌশল ও আপোষ প্রস্তাব ব্যর্থ হওয়ার পর আবু লাহাবের নেতৃত্বে কুরায়েশ নেতাদের মধ্য থেকে ২৫ জনের একটি কমিটি গঠিত হয় এবং সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, মুহাম্মাদ ও তাঁর সাথীদের বিরুদ্ধে এখন থেকে কঠোরতম নির্যাতন চালাতে হবে। মুসলিমরা অধিকাংশই সমাজের দুর্বল শ্রেণীর। আবু বকর, ওছমান প্রমুখ যারা উচ্চ শ্রেণীর আছেন, তারা ভদ্র মানুষ।
দুষ্টদের অভদ্রতার সামনে তারা মুহাম্মাদকে রক্ষা করার ক্ষমতা রাখেন না। সমস্যা হল খোদ মুহাম্মাদ ও তাঁর চাচা আবু তালেবকে নিয়ে। এ দুজনই অত্যন্ত সম্মানিত ও ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন মানুষ। তাদের উপরে হস্তক্ষেপ করলে তাদের দুটি গোত্র বনু হাশেম ও বনু মুত্তালিব ঝাঁপিয়ে পড়বে। যদিও তারা মুশরিক। সবদিক ভেবেচিন্তে তারা দুর্বল মুসলমানদের উপরে নির্যাতনের মাত্রা বৃদ্ধি করার সাথে সাথে মুহাম্মাদ (সাঃ)-কে দৈহিকভাবে ও মানসিকভাবে অপদস্থ করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। যেমন-
১. রাসূলের উপর প্রতিবেশীদের অত্যাচার:
আবু লাহাব ছিল রাসূলের চাচা ও নিকটতম প্রতিবেশী। সে ও তার স্ত্রী ছাড়াও অন্যতম প্রতিবেশী ছিল হাকাম বিন আবুল ‘আছ বিন উমাইয়া, উক্ববা বিন আবু মু‘আইত্ব, আদী বিন হামরা ছাক্বাফী, ইবনুল আছদা আল-হুযালী। এদের মধ্যে কেবল হাকাম বিন আবুল ‘আছ বিন উমাইয়া ইসলাম কবুল করেছিলেন। কাফেররা মুসলিমদের বাড়ির যবেহ করা দুম্বা-ভেড়ার নাড়ি-ভুঁড়ি তারা রাসূলের বাড়ীর মধ্যে ছুঁড়ে মারত।
তাদের বাড়ীর আবর্জনাসমূহ রাসূলের রান্না ঘরের মধ্যে নিক্ষেপ করত যাতে রান্না অবস্থায় সব তরকারি নষ্ট হয়ে যায়। রাসূল সেগুলি কুড়িয়ে এনে দরজায় খাড়া হয়ে তাদের ডাক দিয়ে বলতেন ‘হে বনু আবদে মানাফ! এটা কেমন প্রতিবেশী সূলভ আচরণ?’এরপর তিনি সেগুলি দূরে ফেলে আসতেন।
২. কা‘বা গৃহে ছালাতরত অবস্থায় কষ্টদান:
আব্দুল্লাহ ইবনে মাস‘ঊদ (রাঃ) বলেন যে, একদিন রাসূল (সাঃ) বায়তুল্লাহ্র পাশে ছালাত আদায় করছিলেন। আবু জাহল ও তার সাথীরা অদূরে বসেছিল। কিছুক্ষণ পর তার নির্দেশে ভুঁড়ি এনে সিজদারত রাসূলের দুই কাঁধের মাঝখানে চাপিয়ে দিল, যাতে ঐ বিরাট ভুড়ির চাপে ও দূর্গন্ধে দম বন্ধ হয়ে তিনি মারা যান। ইবনু মাসঊদ বলেন, আমি সব দেখছিলাম।
কিন্তু এই অবস্থায় আমার কিছুই করার ক্ষমতা ছিল না। অন্যদিকে শত্রুরা দানবীয় উল্লাসে ফেটে পড়ছিল। এই সময় কিভাবে এই দুঃসংবাদ ফাতেমার কানে পৌঁছলে তিনি দৌঁড়ে এসে ভুঁড়িটি সরিয়ে দিয়ে পিতাকে সাক্ষাত মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচান। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মাথা উঁচু করে তিনবার বলেন,
‘হে আল্লাহ তুমি কুরায়েশকে ধরো (তিনবার)! হে আল্লাহ তুমি আমর ইবনে হেশাম আবু জাহলকে ধরো। হে আল্লাহ তুমি উৎবা ও শায়বাহ বিন রাবী‘আহ, অলীদ বিন উৎবা, উমাইয়া বিন খালাফ, ওক্ববা বিন আবু মু‘আইত্ব এবং উমারাহ বিন অলীদকে ধরো’। ইবনু মাস‘ঊদ বলেন, আমি তাদের (উক্ত ৭ জনের) সবাইকে বদর যুদ্ধে নিহত হয়ে কূয়ায় নিক্ষিপ্ত অবস্থায় দেখেছি’। (মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৫৮৪৭; ‘রাসূলের আবির্ভাব ও অহি-রসূচনা’ অনুচ্ছেদ।)
৩. সম্মুখে ও পশ্চাতে নিন্দা করা ও অভিশাপ দেওয়া:
এ ব্যাপারে উমাইয়া বিন খালাফ অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। সে পশ্চাতে সর্বদা নিন্দা করত। তাছাড়া রাসূলকে দেখলেই তাঁর সামনে গিয়ে যাচ্ছে তাই বলে নিন্দা ও ভৎর্সনা করত এবং তাঁকে অভিশাপ দিত। এ প্রসঙ্গেই নাযিল হয়,
وَيْلٌ لِّكُلِّ هُمَزَةٍ لُّمَزَةٍ
‘প্রত্যেক সম্মুখ নিন্দাকারী ও পশ্চাতে নিন্দাকারীর জন্য রয়েছে ধ্বংস’ (হুমাযাহ১০৪/১)।
৪. রাসূলের মুখে থুথু নিক্ষেপ করা:
(ক) উমাইয়া বিন খালাফের ভাই উবাই বিন খালাফ ছিল আরেক দুরাচার। সে যখন শুনতে পেল যে, ওক্ববা বিন আবু মু‘আইত্ব রাসূলের কাছে বসে কিছু আল্লাহর বাণী শুনেছে, তখন ভীষণ ক্ষেপে গিয়ে ওক্ববাকে বাধ্য করল যাতে সে তৎক্ষণাৎ গিয়ে রাসূলের মুখে থুথু নিক্ষেপ করে আসে। ওক্ববা তাই-ই করল।
(খ) অনুরূপ এক ঘটনায় একদিন আবু লাহাবের পুত্র উতায়বা বিন আবু লাহাব এসে রাসূল (সাঃ)-কে বলল, আমি সূরা নাজমের ১ ও ৮ আয়াত (وَالنَّجْمِ إِذَا هَوَى- ثُمَّ دَنَا فَتَدَلَّى) দু’টিকে অস্বীকার করি বলেই একটা হেঁচকা টানে রাসূলের গায়ের জামা ছিঁড়ে দিল এবং তাঁর মুখে থুথু নিক্ষেপ করল। আল্লাহর রাসূল (সাঃ) তখন তাকে বদ দোআ করে বললেন, اللهم سلط عليه كلبا من كلابك ‘আল্লাহ তুমি এর উপরে তোমার কোন একটি কুকুরকে বিজয়ী করে দাও’ । কিছুদিন পরে ওতায়বা সিরিয়ায় ব্যবসায়িক সফরে গেলে সেখানে যারক্বা নামক স্থানে রাত্রি যাপন করে।
এমন সময় হঠাৎ একটা বাঘকে সে তাদের চারপাশে ঘুরতে দেখে ভয়ে বলে উঠল, ‘আল্লাহর কসম! এ আমাকে খেয়ে ফেলবে। এভাবেই তো মুহাম্মাদ আমার বিরুদ্ধে দো‘আ করেছিল। সে আমাকে হত্যা করল। অথচ সে মক্কায় আর আমি শামে’। পরদিন সকালে বাঘ এসে সবার মধ্য থেকে তাকে ধরে নিয়ে ঘাড় মটকে হত্যা করল।
৫. রাসূলের মুখে পচা হাড্ডি চূর্ণ ছুঁড়ে মারা :
উবাই বিন খালাফ নিজে একবার মরা-পচা হাড্ডি চূর্ণ করে রাসূলের কাছে গিয়ে তাঁর মুখের দিকে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেয়। যাতে তাঁর মুখ ভর্তি হয়ে যায় এবং দুর্গন্ধে বমি হবার উপক্রম হয়।
৬. তার সামনে এসে মিথ্যা শপথ করা এবং পরে চোগলখুরী করা:
রাসূলকে নির্যাতনকারীদের মধ্যে অন্যতম সেরা বদমাশ ছিল আখনাস বিন শুরাইক্ব ছাক্বাফী। সে ভাল মানুষ সেজে রাসূলের সামনে মিথ্যা শপথ করে কথা বলত এবং পরে লোকদের কাছে গিয়ে চোগলখুরী করত। আল্লাহ পাক তার নয়টি বদ স্বভাবের কথা বর্ণনা করেছেন। যেমন আল্লাহ বলেন,
وَلَا تُطِعْ كُلَّ حَلاَّفٍ مَّهِينٍ- هَمَّازٍ مَّشَّاءٍ بِنَمِيْمٍ- مَنَّاعٍ لِّلْخَيْرِ مُعْتَدٍ أَثِيْمٍ- عُتُلٍّ بَعْدَ ذَلِكَ زَنِيْمٍ-
‘আপনি কথা শুনবেন না ঐ ব্যক্তির, যে অধিক শপথকারী ও হীন স্বভাব বিশিষ্ট’। ‘যে সম্মুখে নিন্দা করে এবং একের কথা অন্যকে লাগিয়ে চোগলখুরী করে’। ‘সে ভালকাজে অধিকহারে বাধাদানকারী, সীমা লংঘনকারী ও পাপিষ্ঠ’। ‘রুক্ষ স্বভাবী এবং সে জারজ সন্তান’ (ক্বলম৬৮/১০-১৩)
ক্বিয়ামতের দিন তার নাসিকা দাগিয়ে দিয়ে চিহ্নিত করে দেওয়া হবে এজন্য যে, অন্যের সামনে তার লাঞ্ছনা যেন পরিষ্কারভাবে ফুটে ওঠে। দুনিয়াতে সে রাসূলের দাওয়াত থেকে নাক সিটকিয়েছিল, তাই ক্বিয়ামতের দিন তার বদলা হিসাবে তার নাসিকা দাগানো হবে। একাজ অন্যেরা করলেও তার পাপ ছিল বেশী এবং সে ছিল নেতা। তাই তাকে সেদিন চিহ্নিত করে দেওয়া হবে।
৭. রাসূলের সামনে বসে কুরআন শোনার পর তাঁকে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করে গর্বের সাথে বুক ফুলিয়ে চলে যাওয়া:
এ কাজটা প্রায়ই আবু জাহল করত, আর ভাবত আমি মুহাম্মাদকে ও তাঁর কুরআনকে গালি দিয়ে একটা দারুণ কাজ করলাম। অথচ তার এই কুরআন শোনাটা ছিল কপটতা এবং লোককে একথা বুঝানো যে, আমার মত আরবের সেরা জ্ঞানী ব্যক্তির নিকটেই যখন কুরআনের কোন মূল্য নেই, তখন তোমরা কেন এর পিছনে ছুটবে? আবু জাহলের এই কপট ও গর্বিত আচরণের কথা বর্ণনা করেন আল্লাহ এভাবে-
فَلَا صَدَّقَ وَلَا صَلَّى- وَلَكِنْ كَذَّبَ وَتَوَلَّى- ثُمَّ ذَهَبَ إِلَى أَهْلِهِ يَتَمَطَّى-
‘সে বিশ্বাস করেনি এবং ছালাত আদায় করেনি’। ‘পরন্তু সে মিথ্যারোপ করেছে ও পৃষ্ঠপ্রদর্শন করেছে’। ‘অতঃপর সে দম্ভভরে নিজ পরিবারের কাছে ফিরে গিয়েছে’ (ক্বিয়ামাহ৭৫/৩১-৩৩)।
৮. কা‘বা গৃহে ছালাত আদায়ে নানারূপ বাধা সৃষ্টি :
(ক) প্রথম দিকে সকালে ও সন্ধ্যায় দু’রাক‘আত করে ছালাত আদায়ের নিয়ম ছিল। প্রথম তিন বছর সকলে সেটা গোপনে আদায় করতেন। পরবর্তীতে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এটা প্রকাশ্যে কা‘বা গৃহে আদায় করতে থাকেন। একদিন তিনি ছালাত আদায় করছেন। এমন সময় আবু জাহল গিয়ে তাঁকে ধমকের সুরে বলল, ألم أنهك عن هذا يا محمد! ‘হে মুহাম্মাদ! আমি কি তোমাকে এসব করতে নিষেধ করিনি’? তখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাকে পাল্টা ধমক দেন। এতে সে বলে,
بأى شيء تهددنى يا محمد أما والله إنى لأكثر هذا الوادى ناديًا.
‘কিসের জোরে তুমি আমাকে ধমকাচ্ছ। আল্লাহর কসম! মক্কার এই উপত্যকায় আমার বৈঠক সবচেয়ে বড়’। অর্থাৎ আমার দল সবচেয়ে বড়। তখন আল্লাহ সূরা আলাক্ব-এর নিম্নোক্ত আয়াত গুলি নাযিল করেন।(তিরমিযীহা/৩৩৪৯, সিলসিলাছাহীহাহহা/২৭৫। )
كَلَّا إِنَّ الْإِنسَانَ لَيَطْغَى- أَن رَّآهُ اسْتَغْنَى- إِنَّ إِلَى رَبِّكَ الرُّجْعَى- أَرَأَيْتَ الَّذِي يَنْهَى- عَبْداً إِذَا صَلَّى- أَرَأَيْتَ إِنْ كَانَ عَلَى الْهُدَى- أَوْ أَمَرَ بِالتَّقْوَى- َرَأَيْتَ إِنْ كَذَّبَ وَتَوَلَّى- أَلَمْ يَعْلَمْ بِأَنَّ اللَّهَ يَرَى- كَلَّا لَئِن لَّمْ يَنتَهِ لَنَسْفَعاً بِالنَّاصِيَةِ- نَاصِيَةٍ كَاذِبَةٍ خَاطِئَةٍ- فَلْيَدْعُ نَادِيَه- سَنَدْعُ الزَّبَانِيَةَ- كَلَّا لَا تُطِعْهُ وَاسْجُدْ وَاقْتَرِبْ-
‘কখনোই না। সত্য-সত্যই মানুষ সীমা লংঘন করে’। ‘এ কারণে যে, সে নিজেকে অভাবমুক্ত মনে করে’। ‘নিশ্চয়ই আপনার প্রভুর দিকেই সবার প্রত্যাবর্তন হবে’। ‘আপনি কি তাকে (আবু জাহলকে) দেখেছেন যে নিষেধ করে’? ‘এক বান্দাকে (রাসূলকে) যখন সে ছালাত আদায় করে’। ‘আপনি কি দেখেছেন যদি সে সৎপথে থাকে’। ‘অথবা আল্লাহ ভীতির নির্দেশ দেয়’। ‘আপনি কি দেখেছেন যদি সে মিথ্যারোপ করে ও মুখ ফিরিয়ে নেয়’। ‘সে কি জানেনা যে, (তার ভাল মানুষী ও মিথ্যাচার সবই) আল্লাহ দেখেন’। ‘কখনোই না’, যদি সে বিরত না হয়, তবে আমি তার মাথার সামনের কেশগুচ্ছ ধরে কষে টান দেব’। ‘মিথ্যুক পাপিষ্ঠের কেশগুচ্ছ’। ‘অতএব সে তার পারিষদবর্গকে ডাকুক’। ‘আমরাও ডাকব আযাবের ফেরেশতাদের’। ‘কখনোই না। আপনি তার কথা শুনবেন না। আপনি সিজদা করুন ও (আপনার প্রভুর) নৈকট্য তালাশ করুন’ (আলাক্ব৯৬/৬-১৯)।
আবু জাহল ও রাসূলের মধ্যকার এই ঘটনা স্মরণ করে এই আয়াত পাঠের পর পাঠক ও শ্রোতাকে সিজদা করার বিধান দেওয়া হয়েছে’।(মুসলিম, মিশকাতহা/১০২৪ ‘ছালাত’ অধ্যায়, ২১অনুচ্ছেদ) ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, এতদ্ব্যতীত আবু জাহল অন্যান্যদেরকে প্ররোচিত করেছিল যে, মুহাম্মাদ যখন কুরআন তেলাওয়াত করে তখন তোমরা হৈ-হুল্লোড় ও হট্টগোল করবে, যাতে কেউ তার তেলাওয়াত শুনতে না পায়। এ প্রসঙ্গে আয়াত নাযিল হয়-
وَقَالَ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا لاَ تَسْمَعُوْا لِهَذَا الْقُرْآنِ وَالْغَوْا فِيْهِ لَعَلَّكُمْ تَغْلِبُوْنَ- فَلَنُذِيْقَنَّ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا عَذَاباً شَدِيْداً وَلَنَجْزِيَنَّهُمْ أَسْوَأَ الَّذِيْ كَا نُوْا يَعْمَلُوْنَ-
‘আর কাফেররা বলে যে, তোমরা এ কুরআন শুনোনা এবং এর তেলাওয়াত কালে হট্টগোল কর, যাতে তোমরা জয়ী হও’। ‘আমরা অবশ্যই কাফিরদের কঠিন আযাব আস্বাদন করাব এবং আমরা অবশ্যই তাদের কাজের হীনতম বদলা নেব’ (হামীম সাজদাহ ৪১/২৬-২৭)।
এইভাবে হোটেলে ও বাজারে ব্যস্ততার সময় মাইকে কুরআন তেলাওয়াতের ক্যাসেট চালানোও ঠিক নয়। কেননা কুরআন শোনার জন্য মনোযোগ দেওয়া শর্ত। অথচ ঐ সময় মনোযোগ দেওয়া যায় না।
১০. সত্যনবী হ’লে তাকে অমান্য করায় গযব নাযিল হয় না কেন বলে যুক্তি প্রদর্শন করা:
নযর বিন হারিছ প্রমুখ কুরায়েশ নেতারা নও মুসলিমদের সম্মুখে এবং নিজেদের লোকদের সম্মুখে জোরে-শোরে একথা প্রচার করত যে, যদি মুহাম্মাদ সত্য নবী হতেন ও তার আনীত কুরআন সত্য কিতাব হয়ে থাকে, তাহলে তা অমান্য করার অপরাধে আমাদের উপরে গযব নাযিল হয় না কেন? বস্ত্ততঃ তাদের এসব কথা দ্বারা দুর্বলদের মন আরও দুর্বল হয়ে যেত এবং ইসলাম গ্রহণ করা হতে মানুষ পিছিয়ে যেত। তাদের এই দাবী ও তার জওয়াবে আল্লাহ বলেন,
وَإِذَا تُتْلَى عَلَيْهِمْ آيَاتُنَا قَالُوْا قَدْ سَمِعْنَا لَوْ نَشَاءُ لَقُلْنَا مِثْلَ هَـذَا إِنْ هَـذَا إِلاَّ أَسَاطِيْرُ الْأَوَّلِيْنَ- وَإِذْ قَالُوْا اللَّهُمَّ إِنْ كَانَ هَـذَا هُ وَ الْحَقَّ مِنْ عِنْدِكَ فَأَمْطِرْ عَلَيْنَا حِجَارَةً مِّنَ السَّمَاءِ أَوِ ائْتِنَا بِعَذَابٍ أَلِيْمٍ- وَمَا كَانَ اللهُ لِيُعَذِّبَهُمْ وَأَنْتَ فِيْهِمْ وَمَا كَانَ اللهُ مُعَذِّبَهُمْ وَهُمْ يَسْتَغْفِرُوْنَ-
‘যখন তাদের নিকটে আমাদের আয়াত সমূহ পাঠ করা হয়, তখন তারা (তাচ্ছিল্যের সাথে) বলে, আমরা শুনেছি, ইচ্ছা করলে আমরাও এরূপ বলতে পারি। এসব তো পূর্ববর্তীদের উপকথা ভিন্ন কিছুই নয়’। ‘এতদ্ব্যতীত যখন তারা বলতে আরম্ভ করে যে, হে আল্লাহ! যদি এটাই তোমার নিকট থেকে আগত সত্য দ্বীন হয়ে থাকে, তাহ’লে তুমি আমাদের উপরে আসমান থেকে প্রস্তর বর্ষণ কর কিংবা আমাদের উপরে বেদনাদায়ক আযাব নাযিল কর’। ‘অথচ আল্লাহ কখনোই তাদের উপরে আযাব নাযিল করবেন না, যতক্ষণ আপনি তাদের মধ্যে অবস্থান করবেন। তাছাড়া তারা (দুর্বল মুসলমানেরা) যতক্ষণ ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকবে, আল্লাহ কখনো তাদের উপরে আযাব দিবেন না’ (আনফাল ৮/৩১-৩৩)।
আয়াত তিনটির মর্মকথা:
উপরোক্ত তিনটি আয়াতের মধ্যে প্রথম আয়াতে কাফেররা ‘কুরআনকে পুরাকালের ইতিকথা এবং ইচ্ছা করলে আমরাও এরূপ বলতে পারি’ বলে দম্ভ প্রকাশ করেছে। অথচ ঐ নেতারা নিজেরাই গোপনে রাতের অন্ধকারে বাইরে দাঁড়িয়ে তাহাজ্জুদের ছালাতে রাসূলের সুমধুর তেলাওয়াত শুনত। আর ফিরে যাওয়ার সময় মন্তব্য করত ليس هذا كلام البشر ‘এটা কখনোই মানুষের কালাম নয়’।
দ্বিতীয় আয়াতে কাফের নেতাদের আরেকটি কৌশল বর্ণিত হয়েছে যে, মুহাম্মাদ সত্যনবী হলে তাকে অমান্য করার কারণে আমাদের উপরে গযব নাযিল হয় না কেন? অথচ তারা ভালভাবেই জানত যে, আল্লাহ তার বান্দাকে বুঝবার ও তওবা করার অবকাশ দিয়ে থাকেন।
তারা রাসূলকে ‘ছাবেঈ’ (صابئ) অর্থাৎ বিধর্মী, ও ‘কাযযাব’ (كذّاب) অর্থাৎ ‘মহা মিথ্যাবাদী’ এবং ‘সমাজে বিভক্তি সৃষ্টিকারী’ বলেছিল। আর সেকারণ তাকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। বর্তমান যুগে ইসলামের শত্রুরা দ্বীনের সত্যিকারের সেবকদের বিরুদ্ধে একই অপবাদ ও একই কৌশল অবলম্বন করেছে। তারাও আল্লাহর গযব সঙ্গে সঙ্গে নাযিল না হওয়াকে তাদের সত্যতার পক্ষে দলীল হিসাবে পেশ করে এবং সমাজ সংস্কারক দ্বীনদার ব্যক্তির অত্যাচারিত হওয়াকে তার অসত্য হওয়ার প্রমাণ হিসাবে যুক্তি পেশ করে থাকে।
তৃতীয় আয়াতে আল্লাহ কাফেরদের কথার জওয়াবে বলেন, যতক্ষণ হে মুহাম্মাদ! আপনি তাদের মধ্যে অবস্থান করবেন অথবা আপনার হিজরতের পরেও যতদিন মক্কার দুর্বল ঈমানদারগণ আমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকবে, ততদিন আল্লাহ কখনোই তাদের উপর গযব নাযিল করবেন না।
কারণ একজন নবী ও ঈমানদারের মূল্য সমস্ত আরববাসী এমনকি সারা পৃথিবীর সমান নয়। এ কারণেই হাদীছে এসেছে, لاتقوم الساعة حتى لايقال فى الأرض: الله الله ‘অতদিন ক্বিয়ামত হবে না, যতদিন পৃথিবীতে একজন আল্লাহ বলার মত (প্রকৃত তাওহীদপন্থী ঈমানদার) লোক বেঁচে থাকবে’।
১১. রাস্তায় ছেলে-ছোকরাদের লেলিয়ে দেওয়া:
উপরে বর্ণিত অত্যাচার সমূহের সাথে যোগ হল একটি নিষ্ঠুরতম অত্যাচার। সেটি হল নেতাদের কারসাজিতে ছেলে-ছোকরাদের অত্যাচার। যেহেতু ছোট ছেলেদের সাত খুন মাফ। তাই নেতারা তাদের কাজে লাগালো। আধুনিক পরিভাষায় নেতারা হল গডফাদার এবং ছোকরারা হল টিন এজার সন্ত্রাসী।
আল্লাহর রাসূল (সাঃ) যখন রাস্তায় বেরোতেন, তখনই আগে থেকে ওঁৎ পেতে থাকা ছোকরার দল ছুটে আসত। আল্লাহর রাসূল (সাঃ) ওদের সালাম দিতেন। ওরা পাল্টা গালি দিত। তিনি ওদের উপদেশ দিতেন। ওরা তখন হি হি করে অট্টহাস্য করত। এভাবে কোন এক পর্যায়ে যখন ওরা রাসূলের দিকে ঢিল ছুঁড়ে মারা শুরু করত, তখন রাসূল (সাঃ) আবু সুফিয়ানের গৃহে আশ্রয় নিতেন।
তখন ছোকরারা চলে যেত। আবু সুফিয়ান বাহ্যিক সৌজন্য বজায় রাখতেন। সম্ভবতঃ এরই প্রতিদান স্বরূপ মক্কা বিজয়ের রাতে সুফিয়ান গোপন অভিযানে এসে ধরা পড়লে রাসূল (সাঃ) তাকে মাফ করে দেন এবং ঘোষণা দেন, ‘যে ব্যক্তি আবু সুফিয়ানের গৃহে আশ্রয় নিবে, সে ব্যক্তি নিরাপদ থাকবে।
                               
Previous Post Next Post