সাহাবীগণের উপর অত্যাচার

সাহাবীগণের উপর অত্যাচার

সাহাবীগণের উপর অত্যাচার
★★★ নিম্নে উদাহরণ স্বরূপ জাহেলী যুগের নির্যাতনের কিছু দৃষ্টান্ত পেশ করা হল।-
(১) মদীনায় প্রেরিত ইসলামের প্রথম দাঈ মুছ‘আব বিন উমায়ের (রাঃ) ইসলাম কবুল করেছেন, এ সংবাদ জানতে পেরে তার মা তার খানাপিনা বন্ধ করে দেন। অবশেষে বাড়ি থেকে বহিষ্কার করেন। বিলাস-ব্যসনে লালিত-পালিত এই তরুণ অবশেষে ক্ষুৎ-পিপাসায় কাতর হয়ে অস্থি-চর্মসার ও কংকাল সর্বস্ব হয়ে পড়েছিলেন। ইনি ওহোদের যুদ্ধে শহীদ হন।
(২) ইসলামের প্রথম ও শ্রেষ্ঠ মুওয়াযযিন বেলাল বিন রাবাহ (রাঃ) কুরায়েশ নেতা উমাইয়া বিন খালাফের হাবশী ক্রীতদাস ছিলেন। ইসলাম কবুল করার অপরাধে তাকে তার মনিব নানাবিধ নির্যাতন করে। তার হাত-পা বেঁধে পিটিয়ে রক্তাক্ত করে প্রখর রৌদ্রে উত্তপ্ত বালুকার উপর উপুড় করে পাথর চাপা দিয়ে ফেলে রাখা হত।
কখনো তার গলায় দড়ি বেঁধে গরু-ছাগলের মত ছেলে-ছোকরাদের দিয়ে পাহাড়ে ও প্রান্তরে টেনে-হিচঁড়ে নেওয়া হত। যাতে তার গলার চামড়া রক্তাক্ত হয়ে যেত। খানা-পিনা বন্ধ রেখে ক্ষুৎ-পিপাসায় কষ্ট দেওয়া হত। কখনো উত্তপ্ত কংকর-বালুর উপরে হাত-পা বেঁধে ফেলে রেখে বুকে পাথর চাপা দেওয়া হত আর বলা হত
‘মুহাম্মাদের দ্বীন পরিত্যাগ না করা পর্যন্ত তোকে আমৃত্যু এভাবেই পড়ে থাকতে হবে’।
কিন্তু বেলাল শুধুই বলতেন ‘আহাদ’ ‘আহাদ’। একদিন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) পাশ দিয়ে যাবার সময় এই দৃশ্য দেখে বললেন
أحد ينجيك ‘আহাদ’ অর্থাৎ আল্লাহ তোমাকে মুক্তি দেবেন’।
অতঃপর তিনি আবু বকরকে যেয়ে বললেন, হে আবুবকর। বেলাল আল্লাহর পথে শাস্তি ভোগ করছে’। আবুবকর ইঙ্গিত বুঝলেন। অতঃপর উমাইয়ার দাবী অনুযায়ী নিজের কাফের গোলাম নিসতাস এর বিনিময়ে এবং একটি মূল্যবান চাদর ও দশটি উকিয়ার (স্বর্ণমুদ্রা) বিনিময়ে তাকে খরিদ করে মুক্ত করে দেন।
(৩) খাববাব ইবনুল আরিত বনু খোযা‘আ গোত্রের জনৈকা মহিলার গোলাম ছিলেন। মুসলমান হওয়ার অপরাধে মুশরিক নেতারা তার উপরে লোমহর্ষক নির্যাতন চালায়। নানাবিধ অত্যাচারের মধ্যে সবচাইতে মর্মান্তিক ছিল এই যে, তাকে কাঠের জ্বলন্ত অঙ্গারের উপরে চিৎ করে শুইয়ে দিয়ে বুকের উপরে পাথর চাপা দেওয়া হয়েছিল।
ফলে পিঠের চামড়া ও মাংস গলে অঙ্গার নিভে গিয়েছিল। ওমর ফারূক (রাঃ) স্বীয় খেলাফতকালে একদিন খাববাবের পিঠের কুঞ্চিত সাদা চামড়া দেখে ও তার উপরে অত্যাচারের কাহিনী শুনে কেঁদে বুক ভাসিয়েছিলেন।
(৪) ইয়াসির পরিবার: ইয়াসির বনু মাখযূমের ক্রীতদাস ছিলেন। তিনি ও তার স্ত্রী ও পুত্র মুসলমান হন। ফলে তাদের উপরে যে ধরনের অমানুষিক নির্যাতন করা হয়েছিল, তা ভাষায় বর্ণনার যোগ্য নয়। আবু জাহলের নির্দেশে বনু মাখযূমের এই ক্রীতদাস মুসলিম পরিবারের উপরে নৃশংসতম শাস্তি নেমে আসে। তাদেরকে খোলা ময়দানে নিয়ে উত্তপ্ত বালুকার উপরে শুইয়ে রেখে নানাভাবে নির্যাতন করা হ’ত। একদিন চলার পথে তাদের এই আযাবের দৃশ্য দেখে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাদের উদ্দেশ্যে বলেন,
صبرًا آل ياسر فإن موعدكم الجنة ‘ধৈর্য ধর হে ইয়াসির পরিবার! তোমাদের ঠিকানা হল জান্নাত’
ইয়াসিরের দুই পায়ে দুটি রশি বেঁধে দুদিকে দুটি উটের পায়ে উক্ত রশির অন্য প্রান্ত বেঁধে দিয়ে উট দুটিকে দুদিকে জোরে হাঁকিয়ে নেওয়া হয়। তাতে জোরে হেঁচকা টানে ইয়াসিরের দেহ দ্বিখন্ডিত হয়ে যায় এবং সেখানেই তিনি শাহাদাত বরণ করেন।
অতঃপর পাষাণহৃদয় আবু জাহল নিজ হাতে ইয়াসিরের স্ত্রী সুমাইয়ার গুপ্তাঙ্গে বর্শা বিদ্ধ করে তাকে হত্যা করে। তিনিই ছিলেন ইসলামে প্রথম মহিলা শহীদ। অতঃপর তাদের একমাত্র পুত্র আম্মারের উপরে শুরু হয় অবর্ণনীয় নির্যাতনের পালা। তাকে উত্তপ্ত কংকরময় বালুর উপরে হাত পা বেঁধে পাথর চাপা দিয়ে ফেলে রাখা অবস্থায় নির্যাতন করা হয়।
একদিন আম্মারকে পানিতে চুবিয়ে আধামরা অবস্থায় উঠিয়ে বলা হল, তুমি যতক্ষণ মুহাম্মাদকে গালি না দিবে এবং লাত-মানাত-উযযা দেব-দেবীর প্রশংসা না করবে, ততক্ষণ তোমাকে মুক্তি দেওয়া হবে না। অবশেষে বাধ্য হয়ে তিনি তাদের কথা মেনে নেন। পরেই তিনি রাসূলের দরবারে গিয়ে কান্না-জড়িত কণ্ঠে সব ঘটনা খুলে বললেন ও আল্লাহর নিকটে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন। তখন নিম্নোক্ত আয়াত নাযিল হয়-
مَنْ كَفَرَ بِاللهِ مِنْ بَعْدِ إيْمَانِهِ إِلاَّ مَنْ أُكْرِهَ وَقَلْبُهُ مُطْمَئِنٌّ بِالْإِيْمَانِ-
‘ঈমান আনার পরে যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে কুফরী করে তাদের জন্য রয়েছে আল্লাহর ক্রোধ এবং কঠিন শাস্তি। কিন্তু যাকে বাধ্য করা হয়, অথচ তার অন্তর বিশ্বাসে অটল থাকে (তার জন্য কোন চিন্তা নেই)’ (নাহল ১৬/১০৬)।
(৫) হযরত ওছমানের মত ধনশালী ব্যক্তি যখন ইসলাম কবুল করেন, তখন তাঁর বদবখ্ত চাচা তাঁকে খেজুর পাতার চাটাইয়ে জড়িয়ে বেঁধে নীচ থেকে ধোঁয়া দিয়ে শাস্তি দেয়।
(৬) কোন কোন ছাহাবীকে উট বা গরুর কাঁচা চামড়ায় জড়িয়ে প্রখর রৌদ্র তাপের মধ্যে ফেলে রাখা হয়। কাউকে লোহার বর্ম পরিয়ে উত্তপ্ত পাথরের উপরে শুইয়ে রাখা হত।
(৭) যানীরাহ, নাহদিয়াহ ও তার মেয়ে এবং উম্মে আবীস প্রমুখ ক্রীতদাসীরা মুসলমান হলে বর্বরতম নির্যাতনের শিকার হন। আবুবকর তাদেরকে খরিদ করে মুক্ত করে দেন। এভাবে কুরায়েশ নেতারা মুসলিম দাস-দাসী ও তাদের পরিবারের উপরে সর্বাধিক নিষ্ঠুরতা প্রদর্শন করত। আবুবকর (রাঃ) এইসব নির্যাতিত দাস-দাসীকে বহু মূল্যের বিনিময়ে তাদের নিষ্ঠুর মনিবদের নিকট থেকে খরিদ করে নিয়ে মুক্ত করে দিতেন।
(৮) খোদ আবুবকর (রাঃ)-কে একদিন ওৎবা বিন রাবী‘আহ তার লোকজন নিয়ে একদিন হঠাৎ আক্রমণ করে বসে। মর্মান্তিক প্রহারে তাঁর চেহারা এমন ফুলে যায় যে, তাকে চেনাই যাচ্ছিল না। বানু তামীম তাকে অজ্ঞান অবস্থায় বাড়ী নিয়ে আসে। সন্ধ্যার পরে তাঁর জ্ঞান ফিরলে প্রথমে জিজ্ঞেস করেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কেমন আছেন?
শত চেষ্টায়ও তিনি কিছু খেলেন না! অবশেষে খাত্তবাব কন্যা উম্মে জামীল এসে গোপনে তাকে খবর দেন যে, রাসূল (সাঃ) ভাল আছেন এবং এখন আরক্বামের গৃহে অবস্থান করছেন। তারপর রাত্রি অধিক হলে উম্মে জামীলের সাথে তিনি আরক্বামের গৃহে যান। সেখানে রাসূলকে দেখার পর কুশল জেনে নিয়ে পানাহার করেন।
আরক্বামের গৃহে প্রচার কেন্দ্র (৫ম নববী বর্ষ):
মুসলমানগণ পাহাড়ের পাদদেশে ও বিভিন্ন গোপন স্থানে মিলিত হয়ে জামাআতের সাথে ছালাত আদায় করতেন এবং দ্বীনের তালীম নিতেন। একদিন কতিপয় মুশরিক এটা দেখে ফেলে এবং মুসলমানদের অশ্রাব্য ভাষায় গালি দিতে দিতে তাদের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তখন হযরত সা‘দ বিন আবী ওয়াকক্বাছ (রাঃ) তাদেরকে পাল্টা আক্রমণ করে রক্তাক্ত করে ফেলেন। ফলে তারা পালিয়ে যায়। এ কারণেই হযরত সা‘দকে ‘আল্লাহর রাস্তায় প্রথম বর্শা নিক্ষেপকারী’ বলা হয়। এটি ছিল চতুর্থ নববী বর্ষের ঘটনা।
এই ঘটনার পরে ৫ম নববী বর্ষে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) আরক্বাম বিন আবুল আরক্বামের বাড়িটিকে প্রশিক্ষণ ও প্রচার কেন্দ্র হিসাবে বেছে নেন। বাড়িটি ছিল ছাফা পাহাড়ের উপরে। যা ছিল অপেক্ষাকৃত নিরাপদ এবং মুশরিকদের দৃষ্টির আড়ালে। কাফের নেতাদের সম্মেলনস্থল ‘দারুন নাদওয়া’ থেকে এটা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন স্থানে। যদিও আল্লাহর রাসূল (সাঃ) নিজে সর্বদা প্রকাশ্যে ছালাত আদায় করতেন।
                               
Previous Post Next Post